Syed Anas Pasha

Syed Anas Pasha

মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রচলিত আদালতে হয়েছে ব্রিটিশ মানবাধিকার নেতাদের শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রীর সাথে মানবাধিকার নেতাদের বৈঠকের নেতৃত্ব দেন লর্ড এভিবারি।
বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনিও উপস্থিত ছিলেন।
ছবি: প্রধানমন্ত্রীর ফটোগ্রাফার
কেন্দ্রীয় লন্ডনের হোটেল হিলটন থেকে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার জনগণের মানবাধিকার রায় সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল। আর মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রচলিত আদালতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তিন মানবাধিকার নেতা রোববার বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার হোটেল স্যুটে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মানবাধিকার নেতারা হচ্ছেন, ব্রিটেনের অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ার লর্ড অ্যাভিবুরি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চাপ্টারের পরিচালক আব্বাস ফয়েজ ও নিউইয়র্কভিত্তিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দণি এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে  আলোচনা করেন তিন মানবাধিকার নেতা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমিও তো মানুষ। আমারও ভাবাবেগ (ইমোশন) আছে। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মা বাবাসহ আত্মীয় স্বজন সবাইকে আমি হারিয়েছে। ’৯৬ সালে মতা পেয়ে প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকেও তো ইচ্ছে করলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে ’৭৫ এর ঘটনায় বঙ্গবন্ধুসহ নিহত সবার হত্যার বিচার করতে পারতাম। কিন্তু তাতো করিনি। প্রচলিত আদালতে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচারের আশায় মামলা দায়েরের পরও রায়ের জন্যে অপো করেছি অনেক বছর।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের কাছে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার জনগণের মানবাধিকার রায় কতটুকু সচেতন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া কি তার প্রমাণ নয়?’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারাজীবন আমার বাবা গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই করেছেন। তার উত্তরসূরী হিসেবে এই লড়াই সেই ছাত্রজীবন থেকেই আমাকেও লড়তে হচ্ছে। জনগণের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার স্বৈর সরকারের নির্যাতন ভোগ করেছি।’

তিনি বলেন, ‘যে জনগণকে সারাজীবন আমার আন্দোলনের মূল শক্তি মনে করেছি, সে জনগণের মানবাধিকার রায় করণীয় সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্র-চর্চার অবাধ সুযোগ থাকলে জনগণ মানবাধিকারসহ সব সুযোগ সুবিধাই ভোগ করতে পারে।

বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র-চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া পৌর নির্বাচন ও সংসদীয় উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আশাব্যঞ্জক ফলাফল না পাওয়াই প্রমাণ করে বাংলাদেশ আজ কিভাবে, কত সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে সরকারের প থেকে কোন ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়নি বলেই আওয়ামী লীগের নিরাপদ আসন হিসেবে পরিচিত একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে মাত্র ১ হাজার ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারতে হয়েছে।’

র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের প্রতি লর্ড অ্যাভিবুরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী  বলেন, ‘২০০৪ সালে র‌্যাবের জন্মের পর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এই বাহিনীকে যেভাবে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে ব্যবহার করেছে, তার তুলনায় এখন তো কিছুই হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে যে ২/১টি ঘটনা ঘটছে তা তো আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই সরকারের প থেকে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী আবারও বলেন, ‘একটি বাহিনীর দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে কিছুটা সময় লাগে। এটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে।’

মানবাধিকার নেতারা সম্প্রতি হাউস অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনারে আলোচিত অশান্ত পার্বত্য চট্রগাম, ওয়ারক্রাইম ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি, গার্মেন্টস সেক্টরে অশান্তি ও বাংলাদেশের পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন রোধে আনিত একটি প্রাইভেট মেম্বার বীলের ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব বিষয়ের প্রতিই সরকারের দৃষ্টি আছে।

লর্ড এভিবারি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১৯৭৩ সালের আইন নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া প্রস্তাবের ভবিষ্যত জানতে  চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। জাতীসংঘও এটি পর্যালোচনা করছে।’

যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্তদের মানবাধিকার রায় সরকার সম্পূর্ণ সচেতন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারো মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।’

পার্বত্য শান্তি চুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে লর্ড এভিবারির অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিরোধী দলগুলোর বাধার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে সরকার এই বিষয়টি মোকাবেলায় সচেষ্ট রয়েছে বলে মানবাধিকার নেতাদের আশ্বস্ত করেন তিনি।

ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি সম্পর্কে মানবাধিকার নেতারা উদ্বেগ জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। শাস্তিও দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী মানবাধিকার নেতাদের জানান, এইসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, শিবীর ও ছাত্রদল কর্মীরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে সরকারকে সাবোটাজ করার জন্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তৈরি পোশাক খাতে সাম্প্রতিক উত্তেজনা সম্পর্কেও একই মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর চেষ্টা করলেও ষড়যন্ত্র করে এই সেক্টরে অশান্ত পরিবেশ জিইয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।

স্টক মার্কেটের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারীও উঠে আসে আলোচনায়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মানবাধিকার নেতাদের জানান, ‘সরকারকে অস্থিতিশীল করতে সুদুর প্রসারী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই এইসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’

বিডিআর ট্রায়ালের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন অভিযুক্তদের মানবাধিকার রায় প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের পার্লামেন্টে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনকে বেআইনি ঘোষণা করার জন্যে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর আনিত একটি বেসরকারি বীলের ভবিষ্যত সম্পর্কে মানবাধিকার নেতারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি তিনি দেখবেন।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, তিন মানবাধিকার নেতার সঙ্গে খুবই আন্তরিক পরিবেশে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরে মানবাধিকার নেতারাও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বলে জানান তিনি।

রাশেদ চৌধুরী আরো জানান, বৈঠকের নির্ধারিত সময় ২০ মিনিট হলেও মানবাধিকার নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক চলে প্রায় ৫০ মিনিটের মতো।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে লর্ড এভিবারির অফিসের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এভিবারির অন্যতম সহকর্মী সুজিত সেন বাংলানিউজকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে লর্ড এভিবারিসহ মানবাধিকার নেতারা খুবই সন্তুষ্ট।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানরবাধিকার নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা খুবই ফলপ্রসু হয়েছে জানিয়ে ঐ কর্মকর্তা বলেন,  মানবাধিকার নেতারা মানবাধিকার বিষয়ে সরকারকে আরো সচেতন হতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। উত্তরে প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার রায় নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

উল্লেখ্য, ৫ দিনের লন্ডন সফর  শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার লন্ডন সময় রাত ৮টা ও বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ২টায় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়বেন। মানবাধিকার নেতারা ছাড়াও  রোববার সারাদিন প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন কমিউনিটি ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেন।


30 Jan 2011   10:40:05 PM   Sunday BdST
 Link to Article

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts