Syed Anas Pasha

Syed Anas Pasha

হাউজ অব লর্ডসে বাংলাদেশ বিষয়ে সেমিনার: বাংলাদেশকে সহযোগিতায় আহ্বান

লন্ডনে হাউজ অব লর্ডসে বাংলাদেশ বিষয়ে সেমিনার। ছবি- সৈয়দ শীশ
লন্ডন: ব্রিটেনের অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ ও ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অ্যাট ক্রস রোড’ শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্রিটেনকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। সোমবার হাউস অব লর্ডসের কমিটি রুমে অনুষ্ঠিত ওই সেমিনারে অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ার ও ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন লর্ড অ্যাভিবুরি তাঁর মূল প্রবন্ধে এই আহবান জানান।

লন্ডন সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সেমিনারে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন সাবেক আইন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিন খসরু ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব করেন বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কমর উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক হুইপ মুজিবুর রহমান সরোয়ার।

বাংলাদেশ বিষয়ে লন্ডনে আয়োজিত সাম্প্রতিক সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে ব্রিটেনের সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও হাউস অব কমন্সের এমপি এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কয়েকজন মানবাধিকার নেতাও বক্তব্য রাখেন।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে লর্ড এভিভারী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশ তার কাক্সিত লক্ষ্যে পৌছার সংগ্রামে অনেকটা পথ এগিয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি। ইস্যুগুলোর মধ্যে বিরোধী দলের পার্লামেন্ট বর্জন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর পদপে গ্রহণে শিথিলতা, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ এবং র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়গুলো উল্লেখ করেন তিনি।
অ্যাভিবুরি  বিএনপি’র পার্লামেন্ট বয়কটের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপির ভাষায় তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ভুয়া দুর্নীতি মামলা, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ‘অপপ্রচার’, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে পার্লামেন্ট। অথচ বিএনপি ওই বিষয়গুলো নিয়ে পার্লামেন্টে যাচ্ছে না। মাসের পর মাস তারা পার্লামেন্ট বয়কট করছে, এটি গণতন্ত্রের জন্যে মোটেই সুখকর নয়।

ব্রিটেনের প্রবীণ এই রাজনীতিক বাংলাদেশর বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে বলেন,  সরকারও তাদের দায়িত্ব পালনে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারছে না। দুর্নীতি রোধে সরকারের শিথিলতা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি সম্প্রতি দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি’র রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেন। লর্ড অ্যাভিবুরি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনকে আরো যুগোপযোগী করার আহবান জানিয়ে বলেন, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনকে আরো যুগোপযোগী করার জন্যে অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্র“পের কাছে পাঠানো ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশগুলো এরই মধ্যে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছি। কিন্তু এগুলোর বিষয়েও বাংলাদেশ সরকারের খুব একটা অগ্রগতির খবর আমরা পাইনি।

সাম্প্রতিক সময়ে গার্ডিয়ানে র‌্যাব-এর মানবাধিকার লংঘনে ব্রিটেনের সম্পৃক্তির কথা উল্লেখ করে লর্ড  অ্যাভিবুরি বলেন, র‌্যাব এর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটি অনেক আগেই উঠছিল। সম্প্রতি এর সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে।

অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ার প্রবীণ এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, কয়েকজন ব্রিটিশ বাঙালিকে র‌্যাবের নির্যাতনের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পৃক্তির বিষয়ে তদন্ত হতে পারে বলে এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে মন্তব্য করা হয়েছে। হাউস অব লর্ডসের অধিবেশনেও বিষয়টি নিয়ে হোম সেক্রেটারিকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।

র‌্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অ্যাভিবুরি বলেন, বাংলাদেশ সরকার এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না, দায়মুক্ত নয় বিরোধী দলও। কারণ যে দল যখনই মতায় এসেছে তখনই র‌্যাব এর এইসব অপকর্মের পে সাফাই গেয়েছে, আর বিরোধী দলে গেলে হয়েছে সমালোচনামুখর। এটি ঠিক নয়। জনগনের মানবাধিকারের বিষয়টি রাজনীতির মারপ্যাঁচে ব্যবহার করা ঠিক নয়।

ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দণি এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সেমিনারে  বলেন, ভারত সরকার মানবাধিকার লংঘনের মত এইসব ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদপে নিচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধু সীমান্তেই নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার রা সরকারের দায়িত্ব। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেও স্বীকৃত বিষয়। এ বিষটির প্রতি গণতান্ত্রিক সব সরকারেরই মনযোগী হওয়া উচিত।

ইউরোপয়ান পার্লামেন্টে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির ফরেন অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক মুখপাত্র চার্লস টেননক এমইপি বিএনপিসহ বিরোধী দলের ভারতবিরোধী প্রচারণার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, আজকের দুনিয়ায় ইচ্ছে করলেই কোনো দেশ অন্য দেশ দখল করতে পারে না। পারস্পরিক সহযোগিতায় উভয় দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সমঝোতা ও সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্যেই বেশি লাভজনক। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আনা বিভিন্ন অভিযোগগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন লন্ডন সফরের সময় উত্থাপন করার কথা জানান সেমিনারকে।

সেমিনারে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বক্তাদের মন্তব্যের জবাবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্মের চল্লিশ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছিল সর্বসাকুল্যে ১০ বছর মতায়। এই সময়ে দেশ ও জাতীর উন্নয়নে আওয়ামী লীগের নেওয়া বিভিন্ন পদপে প্রমাণ করে গণতন্ত্র, সুশাসন ও দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগের অঙ্গিকার কত সুদৃঢ়।

তিনি বিরোধী দলকে পার্লামেন্টে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া, জাতীয় জীবনের গুরুতর সমস্যা সমাধানে বিকল্প পরিকল্পনা হাজির করা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে বিরোধী দলের ইতিবাচক সহযোগিতা আশা করে সরকার ও দেশের জনগণ। তিনি দুঃখ করে বলেন বিরোধী দল দেশের জনগনকে সে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে।
সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সরকারের বিরুদ্ধে আনিত বিভিন্ন অভিযোগের বিস্তারিত জবাব দিয়ে বলেন, বিরোধী দল সরকারেরই অঙ্গ। পার্লামেন্ট বয়কট করে সরকারের অঙ্গহানি ঘটাতে চায় বিএনপি, এটি জাতীর জন্যে সুখকর নয়।

বিএনপি’র প্রতিনিধি কমর উদ্দিন তাঁর দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন হয়রানির বিভিন্ন ডকুমেন্ট সেমিনারের সভাপতির কাছে হস্তান্তর করে বলেন, সরকারের অঙ্গ হিসেবে বিরোধী দলও কাজ করতে চায়। কিন্তু সরকার তাদের কর্মকান্ডের দ্বারা বিরোধী  দলের পার্লামেন্টে যাওয়ার পরিবেশ বার বার নষ্ট করে দিচ্ছে।

 তিনি বলেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নয়, আমরা চাই স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বিচারের মাধ্যমে যেন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হয়। এই বিচার যেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিচারে পরিণত না হয়।

সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেফ্রি উইলসন, লেবার দলীয় এমপি ও অল পার্টি গ্র“প অব বাংলাদেশের চেয়ারপার্সন আন মেইন, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এর প্রফেসর ড. ডেভিড লুইস ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুলতান শরীফ, যুক্তরাজ্য কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব সামসুদ্দিন খান, জালাল উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক,  বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পারভেজ আহমেদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক মহিদুর রহমান ও সহসভাপতি মিয়া মনিরুল আলম প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৭ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১১
Link to Article

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts