Syed Anas Pasha

Syed Anas Pasha


মিলেনিয়ামের জরিপ

বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি রোশনারা


সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
লন্ডন: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো একজন অনাবাসী বাঙালির কৃতিত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের যে কিভাবে আলোড়িত করে তার সর্ব সাম্প্রতিক আরেকটি উদাহরণ রোশনারা আলী, বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি।

যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় বাংলা ম্যাগাজিন ‘মিলেনিয়াম’-এর বিশ্বব্যাপী পরিচালিত জরিপে বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি হিসেবে রোশনারার স্বীকৃতি নতুন করে এই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো ‘বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি’ নির্বাচনের এই বিষয়টি প্রচার করেছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠির সাম্প্রতিক অর্জনগুলোর পেছনে কার কৃতিত্ব কতটুকু এটি যদি আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে না পারি, তাহলে বিশ্বাঙ্গনে বাঙালির সাম্প্রতিক অর্জনের এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে কিভাবে? পূর্ব প্রজন্মের কৃতিত্ব থেকেই তো পরবর্তী প্রজন্ম উৎসাহিত হবে, নতুন নতুন অর্জন নিয়ে আসবে জনগোষ্ঠি, দেশ ও মাতৃভূমির জন্যে। ২০১২ এর ‘মিলেনিয়াম’-এর বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনায় ‘বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি’র জরিপের বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয় উঠে এসেছে।

‘মিলেনিয়াম’ পরিবারের সঙ্গে আমি নিজেও জড়িত থাকায় এই জরিপ কারযক্রমের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবেই সম্পৃক্ত ছিলাম। ২০১২ সালের জন্যে একজন বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি খুঁজে বের করার প্রথম চিন্তাটি মিলেনিয়াম সম্পাদক বন্ধু মাহবুব হোসেনের মস্তিস্ক প্রসূত। এ বিষয়ে যখন আমার মতামত চাইলেন তিনি, সানন্দেই তখন সমর্থন করি তাকে। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো দেশের জন্য কতটুকু সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছে প্রবাসে আমরা যারা বসবাস করছি তারা সবাই বিষয়টি ভালভাবেই উপলব্ধি করছি।

কিভাবে বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি নির্বাচন করা হলো?
‘মিলেনিয়াম’-এর জরিপ কাজের শুরুতে ২০১১ সালের নভেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কাছে ‘বর্ষসেরা অনাবাসী বাংলাদেশি’র জন্যে আমরা মনোনয়ন আহ্বান করি। এ বিষয়ে কাজ করার জন্যে মিলেনিয়াম সম্পাদক মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি। এই কমিটির কাছে জমা পড়ে প্রায় শতাধিক মনোনয়ন। কমিটি এই শতাধিক প্রার্থী থেকে যাচাই-বাছাই করে মোট ১৫টি নাম চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্যে মনোনিত করে। এই ১৫ জনকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৫০০ বাংলাদেশির উপর জরিপ চালায় জরিপ কমিটি। আর এই ৫০০ জনের উপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতেই সেরা নির্বাচিত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রথম ব্রিটিশ এমপি ও শ্যাডো মন্ত্রী রোশনারা আলী। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২০১।

মিলেনিয়াম-এর জরিপে দ্বিতীয় হয়েছেন লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, আর তৃতীয় মার্কিন সিনেটর হ্যানসেন ক্লার্ক। বাছাই ১৫ জনের তালিকায় থাকা অন্যরা হলেন, কানাডার ওন্টারিওর ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান (উপাচারয) অমিত চাকমা, অ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনেলের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানী আতাউল করিম, জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপদেষ্টা ড. মনসুরুল আলম খান, বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, ব্রিটিশ টেলিভিশন উপস্থাপক কনি হক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ফ্রান্স প্রবাসী মূকাভিনেতা পার্থপ্রতীম মজুমদার, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, অলিম্পিক স্মারক মুদ্রার ডিজাইনার সাইমান মিয়া এবং বিজয় ব্যাজের উদ্ভাবক কানাডা প্রবাসী বেলায়েত চৌধুরী রিপন।

কি এমন গুন রোশনারার?
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই তরুণীকে নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। তবে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় ঢাকায় আমি রিপোর্ট করেছি। এই রিপোর্ট করতে সহায়তাও পেয়েছি তাঁর। আর দশটা সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতই একটি পরিবারের মেয়ে রোশনারা। অথচ এই সাধারণের মধ্যেই যেন তিনি ধীরে ধীরে অসাধারণ হয়ে উঠছেন। তাঁর খ্যাতি যে এখন জাতিগত পরিচয়ের
সীমানার বাইরে এটি ইতিমধ্যেই জানান দিতে শুরু করেছেন উদীয়মান এই তরুণী রাজনীতিক। নিজের প্রতিভার গুণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রোশনারা যে নিজের জন্যে একটি উজ্জ্বল আসন খুঁজে নিতে পারবেন, এমপি হিসেবে বিগত দিনে তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এমনই একটি আভাস দিচ্ছে আমাদের।

ব্রিটেন বহু ধর্ম, বহু বর্ণ ও ভিন্ন ভিন্ন জাতীগোষ্ঠির আবাসস্থল। কমিউনিটি হিসেবে অনেকটা অবহেলিত হিসেবেই পরিচিত ছিল এখানকার বাংলাদেশিরা। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর নিজ মেধা ও দক্ষতার গুণে
বাঙালিরা যখন তাদের এই পরিচিতি মুছে ফেলার সংগ্রামে লিপ্ত, ঠিক তখনই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই সংগ্রামী কমিউনিটির প্রতিনিধি হয়ে ঢুকলেন রোশনারা। মূলধারার ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাঙালির অবদানের স্বীকৃতি এনে দিলেন আত্মপ্রত্যয়ী এই বাঙালি তরুণী। এই স্বীকৃতি পেতে গিয়ে আমাদের
কমিউনিটিকে কিন্তু কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। বর্ণবাদ ও মৌলবাদ এই দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে একযোগে সংগ্রাম করেই একজন রোশনারা সৃষ্টি করতে হয়েছে আমাদের। ৭০ দশক থেকে শুরু হওয়া বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামে এখন পর্যন্ত ক্লান্তিহীন ভাবে মাঠে থাকতে হচ্ছে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিকে।

হাজার বছরের বাঙালিয়ানা নিয়ে আমাদের যে গর্ব, সেই বাঙালিয়ানা পরিচয় মুছে ফেলে উগ্র ধর্মান্ধ হিসেবে যখন বাংলাদেশিদের পরিচয় নতুন করে উপস্থাপনের ষড়যন্ত্র হয়, তখন রোশনারা আমাদের সাহস
জোগান এই সংকটকাল মোকাবেলায়। আর তাইতো রোশনারার নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধরা তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ঝুরি নিয়ে মাঠে নেমেছিলো। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরও রোশনারার সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে অপশক্তি এখনও তৎপর।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে রোশনারার আজকের অবস্থান, ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা বাঙালির নতুন প্রজন্মের জন্যে একদিকে যেমন অনুপ্রেরণার উৎস, ঠিক তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ ও দেশটির উপকূলীয় অঞ্চলের জনগনের কাছে রোশনারা হয়ে উঠেছেন একটি ভরসার জায়গা।

প্রথমবার এমপি নির্বাচনের পরপরই শ্যাডো মন্ত্রী হিসেবে রোশনারার নিযুক্তি তার অসাধারণ মেধা ও দক্ষতারই প্রমাণ দেয়।

রোশনারার উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের চল্লিশতম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয় এ অনুষ্ঠানের হোস্ট ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার জন বারকো।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও ছিলেন উপস্থিত। আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক শ্যাডো মন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশে ব্রিটিশ সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতেও রোশনারা বিরাট ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশি অধ্যুষিত তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের মধ্যেও রোশনারা একটি আশা জাগানিয়া চেতনা সৃষ্টি করেছেন।

নিজ নির্বাচনী এলাকা ও বাংলাদেশই শুধু নয়, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশেও রয়েছে রোশনারার সরব  উপস্থিতি। সাম্রাজ্যবাদীদের সৃষ্ট সংঘাত সংঘর্ষ ও যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইরাকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরযাতিত সাধারণ মানুষের পক্ষে রোশনারার উচ্চকণ্ঠ আজ সবাই শুনতে পাচ্ছেন।

কোনো এক সময় আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সাত সমুদ্র তের নদী পারি দিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই পরবাস ব্রিটেনে। ব্রিটেনে স্থায়ী বসতি গড়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তাদের। ভেবেছিলেন, স্বচ্ছল অবস্থার কাছাকাছি যেতে পারলেই ফিরে যাবেন আপন ভূবনে, নিজ মাতৃভূমিতে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখেই সেটি আর হয়নি। স্থায়ী বসতির ইচ্ছে না থাকলেও জীবন মানের প্রয়োজনেই তিল তিল করে গড়ে তুলেতে হয়েছে একটি কমিউনিটি।

এই সমৃদ্ধ কমিউনিটির প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন সাধারণ পরিবারের অসাধারণ মেয়ে রোশনারা। এটি এখন বাঙালির সামগ্রিক ইতিহাসেরই একটি অংশ। এই ইতিহাস আমাদের পরবর্তী
প্রজন্মের জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরও শত শত রোশনারা উজ্জ্বল তারকা হিসেবে আবির্ভূত হবেন এমনই একটি আশা জাগানিয়া আকাঙ্ক্ষাই আমরা এখন হৃদয়ে ধারণ করি।

স্যালুট রোশনারা তোমাকে। তোমার নেতৃত্বে বর্ণবাদ ও মৌলবাদ চিরতরে নিশ্চিন্ন হোক সমাজ থেকে।

‍বাংলাদেশ সময়: ০৭১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১২

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts