Syed Anas Pasha

Syed Anas Pasha

বিমানের লন্ডন অফিস বিক্রির বিপক্ষে প্রবাসীরা

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লন্ডন: বিমানের লন্ডন অফিস বিক্রি পরিকল্পনার খবরে শুরু হয়েছে তোলপাড়। বাংলানিউজের ‘বিমানের লন্ডনের জায়গা বিক্রি করছেন কেভিন’ শীর্ষক খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে কমিউনিটিতে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। লন্ডনে দেশের এই অন্যতম আইকন-তুল্য ভবনটি বিক্রির পরিকল্পনার খবরে হতাশা ব্যক্ত করেছেন শীর্ষস্থানীয় কমিউনিটি সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারা। অনেকেই এই বিক্রি পরিকল্পনার রহস্য সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার তাগিদও অনুভব করছেন।

লন্ডনের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত এই ভবনটি বিক্রি পরিকল্পনার পেছনে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। ১৯৯২ সালে বিমানের তৎকালীন এমডি আব্দুল মুয়িদ চৌধুরীর একান্ত উদ্যোগে কেন্দ্রীয় লন্ডনের ১৭ কনডিউট স্ট্রিটের এই ভবনটি কেনা হয়, সেসময় এর দাম পড়ে সাত লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। লন্ডনের প্রধান ও ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক এলাকা ভায়গো স্ট্রিটে ভাড়া অফিস নিয়ে বিমানের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হলে মুয়িদের একান্ত প্রচেষ্টায় কেনা হয় এই ভবনটি। তখন বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন ফারুক মানিক।

তৎকালীন এমডি আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী পশ্চিম লন্ডনের ভায়গো স্ট্রিটে বিমানের অফিস পরিদর্শনে এলে এই ব্যয়বহুল এলাকায় বিরাট অংকের ভাড়া দিয়ে অফিস পরিচালনার সমস্যার বিষয়টি অনুধাবন করে কান্ট্রি ম্যানেজার ফারুক মানিককে স্থায়ী অফিসের জন্যে ভবন খোঁজার পরামর্শ দিলে কনডিউট স্ট্রিটের এই ভবনটি কেনা হয়, যার বাজার মূল্য বর্তমানে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড। সেই থেকেই বিমানের কার্যক্রম এই নিজস্ব ভবনেই চলে আসছে। কিন্তু কেনার পর ভবনটি আর কোনো ধরনের সংস্কার করা না হওয়ায় ৬তলা ভবনের কোনো কোনো ফ্লোর অনেকটা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সংস্কার-বাজেটের পরিমাণ বিরাট অংকের হওয়ায় লন্ডনের ব্যয়বহুল বাণিজ্যিক এলাকার এই ভবনটি থেকে বিরাট অংকের অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল বিমান।

মঙ্গলবার বাংলানিউজে বিমানের লন্ডন অফিস বিক্রির পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হলে কমিউনিটিতে এর পক্ষে বিপক্ষে বইছে আলোচনার ঝড়। গত মার্চে ব্রিটিশ নাগরিক কেভিন স্টিল বিমানের এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমান লাভজনক হোক এমনই একটি প্রত্যাশা নিয়ে কেভিনের এই নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন অনেকেই। কেভিনও নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী বছর নাগাদ বিমানকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি জাতির সামনে হাজির করবেন। কিন্তু লন্ডনের বিমান অফিস বিক্রির পরিকল্পনার খবর প্রকাশ হওয়ার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে ‘ভিটে মাটি’ বিক্রি করে বিমান কতটুকু লাভজনক হবে।

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক চৌধুরী ভবন বিক্রির তীব্র বিরোধিতা করে বাংলানিউজকে বলেন, লন্ডনে কনডিউট স্ট্রিটের বিমান ভবনের মতো প্রোপার্টির মালিক হওয়া ৯২ সালে সম্ভব হলেও এখন আর তা বাংলাদেশের জন্যে সম্ভব নয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, নিজের ভিটে মাটি কি কেউ কখনও বিক্রি করতে চায়? বরঞ্চ এই ভিটে মাটির সঠিক ব্যবহার করে আয় করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি বলেন, কনডিউট স্ট্রিটের ভবনটি সংস্কার করে কয়েকটি ফ্লোর যদি ভাড়া দেয়া হয়, এই ভাড়া থেকেই বিমান আয় করতে পারে বিপুল অংকের অর্থ। এটিই হতে পারে বিমানের জন্যে উত্তম একটি পরিকল্পনা। আর স্থায়ী সম্পত্তিকে লিকুইডে পরিণত করে লাভবান হওয়া যায়না এটি তো কেভিনের মত একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির না বোঝার কথা নয়।

ইমাদাদুল হক বলেন, বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে আমাদের জানতে হবে এটি বিক্রি করে কি করতে চান কেভিন? লন্ডনের ‘আইকন’তুল্য এই ভবন বিক্রির সঙ্গে বিমানের ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনার সম্পর্ক কি প্রবাসীদের কাছে এটিও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা উচিত। কারণ লন্ডনের এই স্থায়ী সম্পত্তির উপর প্রবাসীদের কিন্ত অধিকার আছে।

লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি নবাব উদ্দিন বিমানের ভবন বিক্রির পক্ষে বা বিরোধিতা না করে বলেন, “বিমানের জন্যে লাভজনক কোনটি হয়, সেটিই আমাদের দেখতে হবে। বিমানের মতো একটি এয়ারলাইন্সের অফিসের জন্যে এত ব্যয়বহুল ভবন ব্যবহার না করে, এটি থেকে আয় কিভাবে করা যায় সেটি বিবেচনা করতে হবে আমাদের। কেভিনের মত একজন এমডি নিশ্চয়ই এ বিষয়টি ভালোই বুঝছেন।”

নবাব বলেন, “সংস্কারের অভাবে লন্ডনের বিমান ভবনটির এখন করুণ দশা। এই অবস্থায় শুধুমাত্র ‘আইকন’ আখ্যা দিয়ে আয়হীন অবস্থায় ভবনটি রেখে দেয়ার পক্ষপাতি নই আমি। এটিকে কাজে লাগাতে হবে।”

ইউকে-বাংলা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব তীব্র বিরোধিতা করছেন ভবন বিক্রির এই পরিকল্পনার। তিনি এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাগিদ অনুভব করছেন এর রহস্য উদঘাটনের। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “কোনো সরকারি সম্পদ বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে আসলে সেই টাকা আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগে না, এই টাকা লুটপাট হয়, এটিই হলো আমাদের দেশের বাস্তবতা। আর লন্ডনের বিমান ভবনের মতো একটি প্রোপার্টি বিক্রি হলে পারসেন্টেজ হিসেবে এই অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা হবে, বিমানের জন্যে কোনো অংশ অবশিষ্ট থাকবে না। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস এটিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।”

ইউকে বিমান অনুমোদিত ট্রাভেলস এসোসিয়েশনের (ইউকেবাটা) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো: আছকির মিয়া অবশ্য বিমান বিক্রির এই পরিকল্পনার খবরটি কতটুকু সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি নবনিযুক্ত এমডি কেভিনকে কাজের সুযোগ দেয়ার জন্যে সকলের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, “বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্যেই একজন বিদেশি নাগরিককে সরকার এই পদে নিয়োগ দিয়েছে। এই নিয়োগের পর বিমানের পরিবর্তনও আমরা লক্ষ্য করছি।”

তিনি বলেন, “লন্ডনের বিমান ভবন নিয়ে নিশ্চয়ই কেভিনের এমন পরিকল্পনা আছে, যে পরিকল্পনা আগামী বছর নাগাদ এই প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করার তাঁর দেওয়া ঘোষণা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং আমাদের তাকে সময় দেওয়া উচিত। এখনই সমালোচনা ও বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করে তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্থ করা উচিত নয়। সময় শেষে উন্নয়ন দৃশ্যমান না হলে তখন হয়তো আমরা সমালোচনা করতে পারি, জবাবদিহীতা দাবি করতে পারি।”

বাংলাদেশ সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বিমান ভবন বিক্রির পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “অতীতে লন্ডনে বাংলাদেশ ভবনটিও বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির এই টাকা দিয়ে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে আরেকটি ভবন ক্রয় করে সেটিও বিক্রি করা হয়। এই বিক্রির টাকা এখন কোথায় আছে, এই টাকা দিয়ে কি করা হয়েছে তা আমরা জানি না। সুতরাং লন্ডনের মত শহরে আমাদের স্থায়ী সম্পত্তিগুলো বিক্রি করে লিকুইডে পরিণত করলে রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যে লাভবান হয় না, এটি অতীত বিক্রির ঘটনাগুলো থেকেই প্রমাণিত।”

তিনি বলেন, “একজন প্রবাসী নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি এত দামি এই প্রোপার্টি বিক্রি করে নয়, সংস্কার করে রেন্টাল আয় বেড় করে নিয়ে আসাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। বিক্রির কোনো উদ্যোগ আমরা প্রবাসীরা মেনে নেবো না।”

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, সম্পত্তিটির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে এ থেকে কিভাবে আয় করা যায় সেটিই দেখা উচিত সংশ্লিষ্টদের। আমি মনে করি এটি বিক্রি করে না ভাড়া দিয়ে এই আয় সম্ভব তা আগে খতিয়ে দেখা উচিত, এরপর সিদ্ধান্ত।

এদিকে, লন্ডনের বিমান ভবন বিক্রির পরিকল্পনার খবরটি এখনও অফিসিয়ালি জানা যায়নি এমন জানিয়ে বিমানের সাথে ঘনিষ্ট একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, আসলে তিনটি অপশন সামনে রেখে লন্ডনের বিমান ভবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। এগুলো হলো ভবনটি সংষ্কার করা, সংষ্কার করে ভাড়া দিয়ে আয় বাড়ানো ও বিক্রি করে দিয়ে বাঙালি অধুষ্যিত পূর্ব লন্ডনে আরেকটি ভবন ক্রয় করা। ওই সূত্র জানায়, উপরোক্ত অপশনগুলোর কোনটি বেছে নেয়া হবে তা সিদ্ধান্ত নেবে বিমান বোর্ড। তিনটি অপশনই বোর্ডে জমা দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ভবনটি বিক্রির পরিকল্পনা হচ্ছে এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেয়া হয়নি বলে বাংলানিউজকে জানায় ওই সূত্র।

বাংলাদেশ সময়: ২২১২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৩

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts